সূরা হুদ; আয়াত ১-৫
সূরা হুদ মাক্কী সূরা। মুফাসসিরদের অধিকাংশই মনে করেন, মদীনায় হিজরতের আগে ভাগে রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন উম্মুল মুমেনিন হযরত খাদিজা (সা.) ও প্রিয় চাচা আবু তালেবের মৃত্যুতে শোকাহত এবং কাফির-মুশরিকদের ক্রমবর্ধমান চাপ ও উৎপীড়নে জর্জরিত তখন এই সূরাটি অবতীর্ণ হয়। এই সূরায় অনেক পয়গম্বরের বিশেষ করে হযরত নূহ (আ.) এর ইতিহাস আলোচিত হয়েছে এবং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তার উম্মতকে ঈমানের ওপর অবিচল থেকে ইসলাম বিরোধীদের মোকাবেলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়েছে। হযরত নূহ ( আ.) এর পর আদ সম্প্রদায়ের কাছে হযরত হুদ (আ.) প্রেরিত হন। তিনি তার সম্প্রদায়কে এক আল্লাহর উপাসনা করার এবং পাপ থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানান। এই সূরার ৫০ থেকে ৬০ নম্বর আয়াতে হযরত হুদ (আ.) এর সঙ্গে আদ জাতির আচরণ এবং তাদের পরিণতি সম্পর্কে বলা হয়েছে।
এই সূরার ১ ও ২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
الر كِتَابٌ أُحْكِمَتْ آَيَاتُهُ ثُمَّ فُصِّلَتْ مِنْ لَدُنْ حَكِيمٍ خَبِيرٍ (1) أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا اللَّهَ إِنَّنِي لَكُمْ مِنْهُ نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ
“আলিফ,লাম,রা,(কুরআন ) এমন এক গ্রন্থ যার আয়াতসমূহ বা বাক্যগুলোকে সুস্পষ্ট ও সুবিন্যস্ত করা হয়েছে। তারপর যিনি প্রজ্ঞাময় ও সর্বজ্ঞ তার পক্ষ থেকে বিশদ ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।” (১১:১)
“যেন তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উপাসনা করবে না। আমি তার পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদ বাহক।” (১১:২)
পবিত্র কুরআনের আরো ২৮টি সূরার মতো এই সূরাটিও ‘হুরুফে মুকাত্তায়া’ বা আরবী বর্ণমালার ‘আলিফ-লাম-রা’ দিয়ে শুরু হয়েছে । এর মাধ্যমে এটা বুঝানো হয়েছে যে, পবিত্র কুরআন হচ্ছে শাশ্বত মুজিযা বা চিরন্তন অলৌকিক নিদর্শন। যা এই বর্ণমালার দ্বারা সন্নিবেশিত হয়ে মানুষের কাছে উপস্থাপিত হয়েছে । পবিত্র কুরআনের কোন সূরার মত এমনকি এর কোন আয়াত বা বাক্যের অনুরূপ কাব্য তৈরি করার সাধ্য কারো নেই। পবিত্র কুরআনের প্রতিটি বাক্যে তওহীদ বা একত্ববাদের প্রাণ সঞ্চারমান, যা কোন কোন আয়াতে প্রতিভাত হয়েছে এবং তা তত্ত্ব, উপদেশ ও বিধানাবলীরূপে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে।
পবিত্র কুরআনই একমাত্র ঐশীগ্রন্থ যা বিবৃতির হাত থেকে সুরক্ষিত রয়েছে এবং যে গ্রন্থের সত্যতা ও মৌলিকত্বের ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। পবিত্র কুরআন হচ্ছে ঐশী গ্রন্থ,এতে বিশ্বজগতের নিগুঢ় রহস্য বিধৃত হয়েছে এবং প্রজ্ঞাময় সর্বজ্ঞ সত্তা মহান আল্লাহ মানব জাতির জন্য এই বিধানাবলী সুবিন্যস্ত করেছেন।
এই সূরার তিন ও চার নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَأَنِ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ يُمَتِّعْكُمْ مَتَاعًا حَسَنًا إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى وَيُؤْتِ كُلَّ ذِي فَضْلٍ فَضْلَهُ وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ كَبِيرٍ (3) إِلَى اللَّهِ مَرْجِعُكُمْ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (4(
“তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর ও তার দিকে প্রত্যাবর্তন কর। তিনি তোমাদেরকে এক নির্দিষ্টকালের জন্য উত্তম জীবন উপভোগ করতে দেবেন এবং তিনি ধর্মাচরণে অধিক নিষ্ঠাবান প্রত্যেককে অধিক দান করবেন। যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তবে আমি তোমাদের জন্য মহাদিনের শাস্তির আশঙ্কা করি।” (১১:৩)
“আল্লাহর নিকটই তোমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে এবং তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।” (১১:৪)
মানুষ যাতে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে সেজন্য পয়গম্বরগণ একত্ববাদ প্রচারের পাশাপাশি মানুষকে তার পাপের জন্য অনুশোচনা করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। নবী রাসূলগণ সব সময় কামনা করতেন যে, ঈমান এবং তাওবার সুফল যেন মানুষ এই পার্থিব জগতেই উপভোগ করতে পারে। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং অতীত পাপের জন্য অনুশোচিত হয়ে মানুষ যাতে এই জগতে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করতে পারে পয়গম্বররা সে চেষ্টাই করে গেছেন। তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে,পাপাচারী এবং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অবিশ্বাসীদের মধ্যে যাদেরকে এ জগতে বাহ্যত প্রাচুর্যের অধিকারী বলে মনে হয়, তারা পরকালে নিশ্চিতভাবে তাদের কর্মের উপযুক্ত পরিণতি ভোগ করবে।
এই সূরার ৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন,
أَلَا إِنَّهُمْ يَثْنُونَ صُدُورَهُمْ لِيَسْتَخْفُوا مِنْهُ أَلَا حِينَ يَسْتَغْشُونَ ثِيَابَهُمْ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ إِنَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ
“সাবধান! তারা তার নিকট গোপন রাখার জন্য তাদের অন্তরের বিদ্বেষ গোপন রাখে। সাবধান! তারা যখন নিজেদের অভিসন্ধি গোপন রাখে তখন তারা যা গোপন রাখে বা প্রকাশ করে তিনি তা জানেন। অন্তরে যা আছে তা তিনি সর্বশেষ অবহিত।” (১১:৫)
কপটতা ও ভণ্ডামি একটি ধর্মপ্রাণ জাতির জন্য বড় হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কপটতা এবং কথায় ও কাজে অমিল, এ ধরনের বৈশিষ্টগুলো মানুষকে বিভ্রান্তির গভীরে নিমজ্জিত করে। যারা মুখে যা বলে কিন্তু অন্তরে তার উল্টো চিন্তা পোষন করে, এ আয়াতে এ ধরনের বৈশিষ্ট্যের মানুষকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। মুনাফিকরা মুসলমানদের ব্যাপারে মনে ভীষণ বিদ্বেষ পোষণ করতো কিন্তু প্রকাশ্যে তারা মুসলমানদের ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করতো। মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সুন্দর সুন্দর কথা বলতো। মুনাফিকদের এই হীন আচরণের ব্যাপারে এই আয়াতে বলা হয়েছে, তারা যা বলে এবং যা তাদের অন্তরে আছে আল্লাহ সবই জানেন। কোন কিছুই আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে নেই।
এই আয়াতে আমাদেরকে এই শিক্ষাই দেয়া হয়েছে যে,যারা ধর্ম ও আদর্শের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের জেনে রাখা উচিত, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে গোপন ও প্রকাশ্য সবই সমান। তিনি সব দেখছেন এবং সবই জানেন। প্রত্যেকের অন্তরে যা আছে তাও আল্লাহর কাছে সুস্পষ্ট।