সূরা ইউনুস; আয়াত ৭৪-৭৮
সূরা ইউনুসের ৭৪ ও ৭৫ নম্বর আয়াতে মহান বলেছেন-
ثُمَّ بَعَثْنَا مِنْ بَعْدِهِ رُسُلًا إِلَى قَوْمِهِمْ فَجَاءُوهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ فَمَا كَانُوا لِيُؤْمِنُوا بِمَا كَذَّبُوا بِهِ مِنْ قَبْلُ كَذَلِكَ نَطْبَعُ عَلَى قُلُوبِ الْمُعْتَدِينَ (74) ثُمَّ بَعَثْنَا مِنْ بَعْدِهِمْ مُوسَى وَهَارُونَ إِلَى فِرْعَوْنَ وَمَلَئِهِ بِآَيَاتِنَا فَاسْتَكْبَرُوا وَكَانُوا قَوْمًا مُجْرِمِينَ (75(
“অতঃপর নুহের পরেও আমি আরো রাসূল তাদের সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করি, তারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ এসেছিল। কিন্তু তারা পূর্বে যা প্রত্যাখ্যান করেছিল; তাতে বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য প্রস্তুত ছিল না, এভাবে আমি সীমালংঘনকারীদের অন্তর সীলমহর করে থাকি।” (১০:৭৪)
“পরে আমার নিদর্শনসহ মুসা ও হারুনকে ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের নিকট প্রেরণ করি। কিন্তু তারা অহংকার করে এবং তারা ছিল অপরাধী সম্প্রদায়।” (১০:৭৫)
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে সত্য ও সঠিক পথ প্রদর্শেনর জন্য যুগে যুগে নবী রাসূল পাঠিয়েছেন। এমন কোন জাতি বা জনপদ নেই যাদের পথ প্রদর্শনের জন্য কোন পয়গম্বরের আবির্ভাব হয়নি। এই দিকটির প্রতি ইঙ্গিত করে এই আয়াতে বলা হয়েছে, নবী রাসূলগণ মুজেজার অধিকারী ছিলেন। অর্থাত তারা আল্লাহর নির্দেশে অলৌকিক কাণ্ড সম্পাদন করতে পারতেন। তারা তাদের দাবির সত্যতা প্রমাণের জন্য এসব মুজেজা বা অলৌকিক ঘটনা দেখাতেন। মানুষও এসব মুজেজা বা অলৌকিক ঘটনায় অভিভুত হয়ে যেত এবং তাদের দাবির সত্যতা উপলব্ধি করতো। কিন্তু কার্যত তারা নবী-রাসূলদের পথ নির্দেশনা গ্রহণ করতো না, কারণ তারা পাপাচারে নিমজ্জিত ছিল। এক পর্যায়ে হযরত নুহ (আ.)-এর সময় বিশ্বের সব জনপদ প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় এবং প্রবল প্লাবনে ধ্বংস হয়ে যায়, শুধু রক্ষা পায় তারাই যারা নুহ নবীকে বিশ্বাস করে তার সাথে নৌকায় আশ্রয় নিয়েছিল। এই ঘটনার পর সময়ের পরিক্রমায় আবার পৃথিবীতে আল্লাহর অবাধ্য বিপথগামী কাফের মুশরিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
মহান আল্লাহ বিপথগামী মানুষদের হেদায়েতের জন্য আবার যুগে যুগে নবী-রাসূলদের পাঠাতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় হযরত ইব্রাহিম, ইসমাইল, হুদ, সালেহ, ইয়াকুব ও ইউসুফ (আ.)-এর আগমন ঘটে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই গোয়ার্তুমির কারণে সত্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। হযরত মুসা (আ.)কে তার ভাই হারুনসহ ফেরাউনের কাছে পাঠানো হয় কিন্তু অভিশপ্ত ফেরাউন হযরত মুসার একত্ববাদের আহবান প্রত্যাখ্যান করে। আত্মম্ভরিতা এবং অহংবোধের কারণে ফেরাউনের পক্ষে সত্যের বাণী গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ সত্য এবং কল্যাণের পথ প্রদর্শনের জন্য নবী রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন। অপরদিকে তিনি মানুষকে জ্ঞান-বু্দ্ধি দিয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতা দিয়েছেন। সৃষ্টিকর্তা চেয়েছেন, বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী মানবজাতি চাপের মুখে নয় বরং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ওপর ভর করে স্বাধীনভাবে তার পথ নির্বাচন করুক।
সূরা ইউনুসের ৭৬ ও ৭৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَلَمَّا جَاءَهُمُ الْحَقُّ مِنْ عِنْدِنَا قَالُوا إِنَّ هَذَا لَسِحْرٌ مُبِينٌ (76) قَالَ مُوسَى أَتَقُولُونَ لِلْحَقِّ لَمَّا جَاءَكُمْ أَسِحْرٌ هَذَا وَلَا يُفْلِحُ السَّاحِرُونَ (77(
“অতঃপর তাদের কাছে যখন আমার নিকট থেকে সত্য এল, তখন তারা বলল, এসব তো স্পষ্ট জাদু।” (১০:৭৬)
“মুসা বলল, সত্য যখন তোমাদের নিকট এল তখন সে সম্পর্কে তোমরা এসব কেন বলছো? একি জাদু! জাদুকরেরা তো সফলকাম হয় না।" (১০:৭৭)
সত্য বিমুখ, বিভ্রান্ত মানুষরা সব যুগেই নবী-রাসূলদেরকে নানা অপবাদে জর্জরিত করেছিল। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে বোঝা যায়, প্রায় সকল নবী-রাসূলকেই অবিশ্বাসীরা জাদুকর আখ্যা দিয়েছিল। তারা জাদুকর আখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষকে এটাই বোঝাবার চেষ্টা করতো যে নবীরা আসলে ধোঁকাবাজ এবং তাদের বক্তব্য মিথ্যা।
প্রতাপশালী ফেরাউনও একই কাজ করেছিল, সে হযরত মুসা (আ.)কে জাদুকর আখ্যা দিয়ে তার সাম্রাজ্যের বড় বড় জাদুকরকে হযরত মুসার মুখোমুখী দাঁড় করালো। কিন্তু কোনো জাদুকরই হযরত মুসার মুজেজার সামনে টিকতে পারলো না। হযরত মুসা ফেরাউনকে উদ্দেশ করে বললেন, আমার কাছ থেকে কি এর আগে কখনো জাদু দেখেছো? সত্যের বাণীকে তুমি জাদু হিসেবে দেখাতে চাচ্ছো, আসলে তুমি মানুষকে সত্য বিমুখ রাখার জন্যই এসব মিথ্যা বলছো !
ইতিহাসে দেখা যাবে এবং বর্তমান সময়েও পাপাচারী বিভ্রান্তগোষ্ঠী সব সময় সত্য ও ইনসাফের বিপরীতে অবস্থান নেয়। তারা ভালো-সত মানুষকে নানা অপবাদ ও কুতসায় জর্জরিত করে। কাজেই ধর্মীয় নেতাদের এটা জানা থাকা উচিত যে , সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ সব সময়ই সত্যের বিরোধীতা করবে।
সূরা ইউনুসের ৭৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قَالُوا أَجِئْتَنَا لِتَلْفِتَنَا عَمَّا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آَبَاءَنَا وَتَكُونَ لَكُمَا الْكِبْرِيَاءُ فِي الْأَرْضِ وَمَا نَحْنُ لَكُمَا بِمُؤْمِنِينَ (78(
“তারা বললো (হে মুসা!) আমাদের পিতৃপুরুষরা যে পথ গ্রহণ করেছিল, তুমি কি তা থেকে বিচ্যুত করার জন্য আমাদের কাছে এসেছ এবং দেশে তোমাদের দু’জনের প্রতিপত্তি কায়েম করতে চাচ্ছো? আমরা তোমাদের দু’জনের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করবো না।" (১০:৭৮)
সমাজে এক শ্রেণীর মানুষ সব সময়ই আছে যারা নিজেদের আকিদা-বিশ্বাস এবং আচার-আচরণের ব্যাপারে ভীষণ গোঁড়া। কোন অবস্থায়ই তারা তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস, কুসংস্কার এবং বদ অভ্যাস ত্যাগ করতে চায় না।
তাদের ধারণা পূর্বপুরুষ হতে প্রাপ্ত বিশ্বাস এবং সংস্কার ভ্রান্ত হতে পারে না। যদি তা ভ্রান্ত হয় তাহলেও তা পরিত্যাগ করা যাবে না, কারণ তাতে পূর্বপুরুষ এবং বংশের অবমাননা হবে।
ইসলাম এ ধরনের একগুঁয়েমী এবং অজ্ঞতাপ্রসূত মন-মানসিকতার অপসারণ চেয়েছে। ইসলাম পূর্বপুরুষ বিশেষ করে মা-বাবার প্রতি সম্মান এবং তাদের সেবা-যত্ন করা বাধ্যতামূলক করেছে কিন্তু আকিদা বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিষ।
আকিদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আবেগ-অনুভূতির স্থান নেই, এর ভিত্তি হতে হবে জ্ঞান-প্রজ্ঞা এবং বিচার বিবেচনা।
প্রত্যেক মানুষ তার জ্ঞান ও স্বাধীন বিচার বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তার পথ নির্ধারণ করবে এবং এটাই ইসলামের আহবান। এক্ষেত্রে পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ, আবেগ ও বিদ্বেষ মানুষকে সত্য থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। নবী-রাসূলদের যারা বিরোধিতা করতো তাদের মন-মানসিকতা ছিল এমন; তারা বলতো আমাদের পূর্বপুরুষরা মূর্তি পূজা করতো, তাই আমরা তা বিসর্জন দিতে পারবো না, এটাই আমাদের যুক্তি।
আসলে পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ, বিদ্বেষ এবং কুসংস্কারে আক্রান্ত এক শ্রেণীর মানুষ যুগে যুগে পয়গম্বরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল।