সূরা ইব্রাহীম;(১১ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা ইব্রাহীম;(১১ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 8:44:11 20-8-1403

সূরা ইব্রাহীম; আয়াত ৪০-৪৫

সূরা ইব্রাহিমের ৪০ ও ৪১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

رَبِّ اجْعَلْنِي مُقِيمَ الصَّلَاةِ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاءِ (40) رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ

"হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এবং আমার বংশধরদের কিছুকে যথাযথ নামাজ প্রতিষ্ঠাকারী করো। হে আমার প্রতিপালক! আমার প্রার্থনা গ্রহণ কর।” (১৪:৪০)

“হে আমার প্রতিপালক! হিসাব গ্রহণের দিন আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং বিশ্বাসীগণকে ক্ষমা কর।" (১৪:৪১)

আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.) যখন তাঁর স্ত্রী বিবি হাজেরা ও সন্তান ইসমাঈলকে শুষ্ক মরুভূমিতে বসবাসের জন্য রেখে যান, তখন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন, হে আমার প্রতিপালক! তাদেরকে এই স্থানে রেখে গেলাম যাতে তারা সঠিকভাবে নামাজ আদায় করতে পারে। এই আয়াতেও তিনি তার সন্তানের জন্য দোয়া করে বললেন, সে যেন নামাজ কায়েমকারীদের অন্তর্ভূক্ত হয় এবং আল্লাহ যেন তার ইবাদত বন্দেগী কবুল করেন। আল্লাহ প্রেরিত নবী রাসূল এবং ওলি আউলিয়াগণ কেবল তাদের নিজেদের নামাজ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন না, সেই সঙ্গে তারা সমাজে নামাজ প্রতিষ্ঠা করা এবং নামাজের সংস্কৃতি চালু রাখার জন্য প্রবলভাবে দায়িত্ববোধ করতেন। যদি সমাজে নামাজ প্রতিষ্ঠিত করা যায় অর্থাৎ মানুষ শুধু নামাজ পড়বে না সেই সঙ্গে আল্লাহর সকল নির্দেশাবলী নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করবে, পরিবার ও সমাজের সাথে নিজের আচরণ সংশোধন করবে, স্বেচ্ছাচারিতা ও অহঙ্কার পরিত্যাগ করে বিনয়ী হবে।

এরপর হযরত ইব্রাহিম নিজের, নিজের পরিবারের এবং সকল বিশ্বাসী লোকের জন্য দোয়া করেন যা থেকে বোঝা যায় তিনি গোটা সমাজকে নিয়েই চিন্তা করতেন। ইসলামে এ বিষয়ে বারবার গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, নিজের চেয়ে অন্যের কল্যাণ কামনা করে বেশী বেশী দোয়া করো। কাজেই দেখা যাচ্ছে, আল্লাহর খাঁটি বান্দাগণের দোয়ার মধ্যে মহান আল্লাহর বিশালত্ব এবং তাঁর তুলনায় মানুষের অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে। এছাড়া আমাদের উচিত দোয়া করার সময় আমাদের পূর্ববর্তী বংশধরদের আত্মার শান্তি কামনার পাশাপাশি অনাগত সন্তানদের কল্যাণ কামনা করা।

সূরা ইব্রাহিমের ৪২ ও ৪৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَلَا تَحْسَبَنَّ اللَّهَ غَافِلًا عَمَّا يَعْمَلُ الظَّالِمُونَ إِنَّمَا يُؤَخِّرُهُمْ لِيَوْمٍ تَشْخَصُ فِيهِ الْأَبْصَارُ (42) مُهْطِعِينَ مُقْنِعِي رُءُوسِهِمْ لَا يَرْتَدُّ إِلَيْهِمْ طَرْفُهُمْ وَأَفْئِدَتُهُمْ هَوَاءٌ

“তুমি কখনও মনে করো না যে, সীমা লংঘনকারীদের কৃতকর্মের ব্যাপারে আল্লাহ উদাসীন। তবে তিনি ওদের সেই দিন পর্যন্ত সময় দেবেন যেদিন (ভয়ে ও আতঙ্কে) তাদের চক্ষু স্থির হয়ে যাবে।” (১৪:৪২)

“হীনতায় আকাশের দিকে চেয়ে ওরা ভীত-বিহবল চিত্তে ছোটাছুটি করবে, নিজেদের প্রতি ওদের দৃষ্টি থাকবে না এবং ওদের অন্তর বিকল হয়ে যাবে।" (১৪:৪৩)

হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর দোয়া বর্ণনা করার পর এই আয়াতে ইসলামের নবী এবং সকল মুমিন বিশ্বাসীদের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে : অত্যাচারীদের সুখে শান্তিতে বসবাস করতে দেখে এবং তাদের ওপর কোন বালা মুসিবত নেমে আসতে না দেখে এটা ভেবো না যে, আল্লাহ তাদের কৃতকর্ম দেখতে পাচ্ছেন না কিংবা তাদের শাস্তি দিতে পারছেন না। মহান আল্লাহ তাঁর প্রজ্ঞাপূর্ণ ঐতিহ্য অনুযায়ী ভালো ও খারাপ উভয় ধরনের মানুষকে তার বিচারবুদ্ধি ও ক্ষমতা অনুযায়ী খুশীমত চলার স্বাধীনতা দিয়েছেন। সেই সাথে বলে দিয়েছেন, ভালো কাজ করলে পুরস্কার এবং খারাপ কাজ করলে শাস্তি পেতে হবে। তবে একটি সমাজের অধিকাংশ মানুষ যখন খারাপ হয়ে যায়, তখন ঐ সমাজের ওপর ঐশী শাস্তি নেমে আসে। কিন্তু এর অর্থ এও নয় যে, আল্লাহ তার বান্দাদের কাছ থেকে স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছেন এবং ভালো ও খারাপ কাজের প্রতিদান কাজটি সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে দিয়ে দেয়া হবে।

মহান আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, সর্বশক্তিমান ও ন্যায়পরায়ন। মানুষ যেন না ভাবে তিনি সবকিছু সম্পর্কে উদাসীন রয়েছেন। এছাড়া গোনাহগার ও অত্যাচারী ব্যক্তিদের সুপথে ফিরে আসার সময় দেয়া আল্লাহর রীতি। এই সময় ও সুযোগকে তাদের কাজে আল্লাহ সন্তুষ্ট রয়েছেন বলে মনে করা যাবে না।

সূরা ইব্রাহীমের ৪৪ ও ৪৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَأَنْذِرِ النَّاسَ يَوْمَ يَأْتِيهِمُ الْعَذَابُ فَيَقُولُ الَّذِينَ ظَلَمُوا رَبَّنَا أَخِّرْنَا إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ نُجِبْ دَعْوَتَكَ وَنَتَّبِعِ الرُّسُلَ أَوَلَمْ تَكُونُوا أَقْسَمْتُمْ مِنْ قَبْلُ مَا لَكُمْ مِنْ زَوَالٍ (44) وَسَكَنْتُمْ فِي مَسَاكِنِ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ وَتَبَيَّنَ لَكُمْ كَيْفَ فَعَلْنَا بِهِمْ وَضَرَبْنَا لَكُمُ الْأَمْثَالَ

"(হে রাসূল!) যেদিন তাদের ওপর শাস্তি নেমে আসবে, সেদিনের ব্যাপারে তুমি মানুষকে সাবধান করে দাও। তখন সীমা লংঘনকারীরা বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমাদের কিছুকালের জন্য সময় দাও যাতে আমরা তোমার আহবানে সাড়া দিয়ে তোমার রাসূলগণের অনুসরণ করতে পারি। (সেদিন তাদের বলা হবে) তোমরা কি পূর্বে শপথ করে বলতে না যে, তোমাদের কোন পরজীবন নেই?” (১৪:৪৪)

“যদিও তোমরা বাস করতে তাদের আবাসভূমিতে যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল এবং তাদের সাথে আমি কী আচরণ করেছি তাও তোমাদের কাছে ছিল স্পষ্ট। তোমাদের সামনে আমি তাদের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছিলাম (কিন্তু তোমরা তা থেকে শিক্ষা নাও নি)।" (১৪:৪৫)

আগের আয়াতে আল্লাহকে উদাসীন ভাবতে নিষেধ করার পর এই আয়াতে বলা হচ্ছে- জেনে রেখ! আল্লাহর শাস্তি যদি পৃথিবীতে নেমে আসে, তবে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য যত সময় ও সুযোগই দাবি করে না কেন, তা কোন কাজে আসবে না। কারণ, ঐশী শাস্তি দেখে মানুষ যে ঈমান আনে তা স্বতঃস্ফূর্ত নয়। ভয়ের কারণে ঐ মুহূর্তে মানুষ সৎপথে ফিরে আসতে চায় বলে তার কোন মূল্য নেই। আয়াতের পরবর্তী অংশে অত্যাচারি ও জালিমদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, তোমাদের যেসব পূর্বসূরির জায়গা-জমি ও ঘরবাড়িতে বসবাস করছো তাদের পরিণতি থেকে তোমরা শিক্ষা নিচ্ছো না কেন? তাদের শাস্তি দেখার পরও তোমরা কেন এ ধরনের আবেদন জানাচ্ছো যে, আল্লাহ পারলে যেন শাস্তি পাঠায়? কেন অতীতের ঘটনা থেকে শিক্ষা না নিয়ে ধারণা করছো যে, আল্লাহর শাস্তি কোনদিনই তোমাদের স্পর্শ করবে না?

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ বলেছেন, পাপী ব্যক্তিরা একদিন তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হবে। কিন্তু সেদিন তাদের তওবা বা অনুশোচনা কোন কাজে আসবে না। এছাড়া, সমাজ ও ইতিহাসের ব্যাপারে আল্লাহর আইন অপরিবর্তিতভাবে চলতেই থাকবে। কাজেই আমাদের উচিত পূর্বসূরিদের ইতিহাস পাঠ করে তা থেকে শিক্ষা নেয়া।