সূরা হিজর; (১ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা হিজর; (১ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 8:35:40 20-8-1403

সূরা হিজর; আয়াত ১-৬

পবিত্র কুরআনের ১৫তম সূরা হিজরের আয়াত সংখ্যা ৯৯টি। এই সূরা বিশ্বনবী (সা.) এর হিজরতের আগে মক্কায় নাযিল হয়। হযরত সালেহ (আ.) এর কওমের শহরের নাম অনুসারে এই সূরার নাম হিজর রাখা হয়েছে এবং সূরার ৮০তম আয়াতে এই নাম উল্লেখিত হয়েছে।

এই সূরার ১ থেকে ৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

الر تِلْكَ آَيَاتُ الْكِتَابِ وَقُرْآَنٍ مُبِينٍ (1) رُبَمَا يَوَدُّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ كَانُوا مُسْلِمِينَ (2) ذَرْهُمْ يَأْكُلُوا وَيَتَمَتَّعُوا وَيُلْهِهِمُ الْأَمَلُ فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ

“আলিফ-লাম-রা। এগুলো (আসমানী) কিতাব ও সুস্পষ্ট কুরআনের আয়াত।” (১৫:১)

“কখনো কখনো অবিশ্বাসী কাফেররা চাইবে যে, তারা মুসলমান হলে কতই না ভালো হতো।” (১৫:২)

“আপনি তাদেরকে তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী চলতে দিন-তারা খেতে থাকুক, ভোগ করতে থাকুক এবং আশা তাদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখুক। অতি সত্বর তারা (পরিণতি) বুঝতে পারবে।" (১৫:৩)

আরো অনেক সূরার মতো এই সূরার শুরুতে পবিত্র কুরআনের উচ্চ মর্যাদা এবং বিভিন্ন রহস্য উন্মোচনে কুরআনের আয়াতসমূহের ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া কুরআনের অপর ২৯টি সূরার মতো এই সূরা মাকতা' হরফ দিয়ে শুরু হয়েছে। মানব রচিত গ্রন্থের সাথে পবিত্র কুরআনের অন্যতম প্রধান পার্থক্য নির্দেশ করে এসব হরফ। আয়াতের পরবর্তী অংশে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, অবিশ্বাসী কাফেররা কখনো কখনো এই পৃথিবীতে, বিশেষ করে শেষ বিচারের দিন আক্ষেপ করে বলবে, তারা যদি ইসলাম গ্রহণ করতো-তাহলে পৃথিবীতে ঈমানদার বিশ্বাসীদের মতো মানসিক শান্তি এবং পরকালে জান্নাত লাভ করতে পারতো। কিন্তু এ ধরনের মানুষ তাদের আকাঙ্খা বাস্তবায়নের জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। তারা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থে ভোগবিলাস ও সাময়িক ইন্দ্রিয় সুখে ব্যস্ত থাকে এবং এসব নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকার কোন প্রবণতা তাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। এ কারণে মহান আল্লাহ তার রাসূল ও মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ওদেরকে ওদের মতো থাকতে দিন, শিগগিরই তারা তাদের কৃতকর্মের পরিণাম উপলব্ধি করবে।

উপযুক্ত যুক্তি ও দলিল প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে কাফেরদের ধর্মের দিকে আহ্বান করার পরও তারা ইসলাম গ্রহণ না করার কারণে তাদেরকে যা খুশি তাই করতে সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। তা না হলে আল্লাহ তো এ ধরনের লোকদের সত্যের আহ্বান জানানোর জন্যই নবী রাসূলদের পাঠিয়েছেন। কিন্তু অবিশ্বাসীরা যখন সত্যের ডাক শুনতে চায় না কিংবা এসব আহ্বান কেন জানানো হচ্ছে- সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতেও আগ্রহ দেখায় না, তখন রাসূলকে অনর্থক তাদের জন্য মন খারাপ করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। এ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয়, আজ যারা মুসলমানদের হাসি-ঠাট্টার পাত্রে পরিণত করছে, একদিন তারা আক্ষেপ করে বলবে, কেন তারা সেদিন ঈমান আনে নি। কাজেই ভালো হওয়ার আকাঙ্ক্ষাই যথেষ্ট নয়, ভালো হওয়ার জন্য চেষ্টাও চালাতে হবে। ধর্মের দিকে মানুষকে আহবানের ক্ষেত্রে তাদের পেছনে সময় নষ্ট করা ঠিক নয়- যারা বুঝে শুনে কাফের ও অবিশ্বাসী থাকার সংকল্প করেছে। মহান আল্লাহ এত বেশী দয়ালু যে তাঁর প্রতি অবিশ্বাসীদেরকেও তিনি নিজের অনুগ্রহ থেকে বিরত রাখেন না। কিন্তু অবিশ্বাসী কাফেররা এসব অনুগ্রহের মর্যাদা উপলব্ধি করে না।

সূরা হিজরের ৪ ও ৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন-

وَمَا أَهْلَكْنَا مِنْ قَرْيَةٍ إِلَّا وَلَهَا كِتَابٌ مَعْلُومٌ (4) مَا تَسْبِقُ مِنْ أُمَّةٍ أَجَلَهَا وَمَا يَسْتَأْخِرُونَ

“আমি কোন জনপদকে তার নির্দিষ্টকাল পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ধ্বংস করিনি।” (১৫:৪)

“কোন জাতি তার নির্দিষ্ট কালকে ত্বরান্বিত বা বিলম্বিত করতে পারে না।" (১৫:৫)

আগের আয়াতে কাফেরদের খারাপ কাজ করতে সময় দেয়ার কথা উল্লেখের পর এই আয়াতে বলা হচ্ছে, আল্লাহর কাছে নির্দিষ্ট করে রাখা এই সময় একদিন ফুরিয়ে যাবে। যখন সময় ফুরিয়ে যাবে তখন অপরাধী জাতি ধ্বংস হবে। সেই সময়কে এগিয়ে আনার বা কিছুটা পিছিয়ে দেয়ার ক্ষমতা কারো নেই। অবশ্য ধ্বংস দুই ধরনের। একটি অবশ্যম্ভাবী, আরেকটি পরিবর্তনযোগ্য। এখানে অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে। আর পরিবর্তনযোগ্য ধ্বংস বা মৃত্যুর সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করা, দান-খয়রাত করা বা মানুষের উপকার করার মাধ্যমে পিছিয়ে দেয়া সম্ভব। এই দুই আয়াত থেকে বোঝা যায়, অবিশ্বাসী কাফেরদের সময় দেয়া যেমন আল্লাহর রীতি তেমনি সময় ফুরিয়ে গেলে তাদেরকে ধ্বংস করাও আল্লাহর বিধান। এছাড়া শুধু মানুষ নয়, সেই সাথে প্রতিটি সমাজ এবং জাতিরও নির্ধারিত সময় রয়েছে যা আল্লাহ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। তিনি ছাড়া ঐ সময় সম্পর্কে কেউ অবহিত নয়।

সূরা হিজরের ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَقَالُوا يَا أَيُّهَا الَّذِي نُزِّلَ عَلَيْهِ الذِّكْرُ إِنَّكَ لَمَجْنُونٌ

"কাফেররা বলল : ওহে! যার প্রতি (তার দাবি অনুযায়ী) কুরআন নাযিল হয়েছে, তুমি তো উন্মাদ।" (১৫:৬)

এই আয়াতে নবী রাসূলদের প্রতি কাফেরদের আচরণের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তারা নবী রাসূলদের পাগল বলতো এবং নিজেদের ভয়ানক বুদ্ধিমান ভাবতো। তাদের দৃষ্টিতে যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে রেসালাতের দায়িত্ব পেয়েছেন এবং যাঁর কাছে আল্লাহর বার্তা বা ওহি আসে বলে দাবি করেন, তাঁর মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণে এ ধরনের কথাবার্তা বলছেন। অবশ্য আরবে জাহিলিয়াত বা অন্ধকার যুগে তাকেই উন্মাদ বলা হতো যার ওপর জিনের প্রভাব রয়েছে। জিনের প্রভাবে উন্মাদ ব্যক্তি উদ্ভট আচরণ বা প্রলাপ বকে বলে আরবদের বিশ্বাস ছিল। তাদের আরো ধারণা ছিল, যারা কবি তাদের ওপরও জিনের প্রভাব রয়েছে। কারণ জিনের সাথে সম্পর্ক ছাড়া কবিতা লেখা সম্ভব নয়। কিন্তু নবী রাসূলদের উন্মাদ বলার ঘটনা থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট হয়। একটি হচ্ছে অবিশ্বাসী কাফেররা আল্লাহর প্রেরিত পুরুষদের সাথে কী ধরনের অবমাননামূলক আচরণ করতো তা এখান থেকে ফুটে ওঠে। এছাড়া, নবী-রাসূলদের অকাট্য দলিল-প্রমাণের সামনে কাফেরদের অসহায়ত্বের বিষয়টিও এই আয়াতে প্রকাশ পেয়েছে। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো যুক্তি-তর্ক প্রত্যাখ্যান করার কোন পথ খুঁজে না পেয়ে নবী রাসূলদের অপমান অপদস্থ করার পথ বেছে নিয়েছে। বর্তমান সময়েও ইসলাম বিরোধীরা একই পন্থা অবলম্বন করছে। পবিত্র কুরআনের কোন শিক্ষার ব্যাপারে তাদের যদি কোন কথা থেকে থাকে, তবে তা যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে উপস্থাপনের পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের ব্যাঙ্গাত্মক পন্থায় তুলে ধরছে। বিক্ষিপ্ত রম্য-রচনা ও বিদ্রুপাত্মক কার্টুনের মাধ্যমে তারা ইসলাম অবমাননার চেষ্টা করছে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে, ইসলাম বিরোধীদের অবমাননামূলক আচরণ ও কথাবর্তা প্রতিহত করার চেষ্টা করতে হবে। সত্য অস্বীকারকারীদের জেদ একটা সময়ে এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, তারা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী বলে মনে করে এবং আল্লাহর প্রেরিত পুরুষদের পাগল বলতেও দ্বিধা করে না।