সূরা আলে ইমরান;আয়াত ২৩-২৭
সূরা আলে ইমরানের ২৩ ও ২৪ তম আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ أُوتُوا نَصِيبًا مِنَ الْكِتَابِ يُدْعَوْنَ إِلَى كِتَابِ اللَّهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ يَتَوَلَّى فَرِيقٌ مِنْهُمْ وَهُمْ مُعْرِضُونَ ( (২৩ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لَنْ تَمَسَّنَا النَّارُ إِلَّا أَيَّامًا مَعْدُودَاتٍ وَغَرَّهُمْ فِي دِينِهِمْ مَا كَانُوا يَفْتَرُونَ (২৪)
"তুমি কি তাদের দেখনি যাদেরকে ঐশীগ্রন্থ তাওরাত দেয়া হয়েছিল? তাদেরকে আল্লাহর গ্রন্থের দিকে আহবান করা হয়েছিল,যাতে তা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয় কিন্তু একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়।" (৩:২৩)
"আল্লাহর বিধান মানতে অস্বীকার করে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এই বলে যে,অল্প ক'দিন ছাড়া দোজখের আগুন তাদেরকে কখনও স্পর্শ করবে না। এইসব কল্পনা ও মিথ্যাচার তাদের ধর্ম বিষয়ে তাদেরকেই প্রতারিত করেছে।" (৩:২৪)
এই আয়াতে ইসলামের নবীর উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে,যদি ইহুদীরা ইসলাম ধর্মের প্রতি ঈমান না আনে,তাহলে আপনি দুঃখিত হবেন না। কারণ,এরা নিজেদের ধর্মই পালন করে না। এদের মধ্যে একজন ব্যাভিচার করার পর ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত অনুযায়ী পাথরের আঘাতে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আপনার শরণাপন্ন হয় এ আশায় যে,ইসলাম ধর্মের আইন হয়তো অন্য রকম হবে। কিন্তু আপনি কোরআনের আইন অনুযায়ী একই শাস্তি দেয়ায় সে তাওরাতের আইনকেও অস্বীকার করেছে এবং আল্লাহর এই বিধানকে গোপন রেখেছে।
পবিত্র কোরআন ইহুদীদের সুবিধাবাদী মানসিকতাকে ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ বলেই গণ্য করেছে। ইহুদীরা ভাবতো তারা আল্লাহর কাছে অন্যদের চেয়ে বেশী প্রিয় এবং ইহুদী জাতিই আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ জাতি। তাই তাদেরকে জাহান্নাম বা বিচার দিবসের মুখোমুখী হতে হবে না অথবা কয়েকদিনের বেশী শাস্তি ভোগ করতে হবে না।
এই আয়াতের শিক্ষনীয় দিকগুলো হলো,
এক : অহংকার করা ও নিজেকে বড় করে দেখার প্রবণতা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনকি ধর্মও যদি এই অহংকারের উৎস হয় তবুও তা বৈধ নয়।
দুই : প্রত্যেক মানুষই পৃথিবীতে ও পরকালে আল্লাহর আইনের কাছে সমান । এক্ষেত্রে কেউই কারো চেয়ে বড় নয়।
এই সূরার ২৫তম আয়াতে বলা হয়েছে-
فَكَيْفَ إِذَا جَمَعْنَاهُمْ لِيَوْمٍ لَا رَيْبَ فِيهِ وَوُفِّيَتْ كُلُّ نَفْسٍ مَا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ (২৫)
"কিন্তু তখন কি অবস্থা দাঁড়াবে যখন আমি তাদেরকে একদিন সমবেত করবো যে দিনের আগমনে কোন সন্দেহ নেই,আর প্রত্যেককেই তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান পূর্ণভাবে দেয়া হবে এবং তাদের প্রতি কোন অন্যায় করা হবে না।" (৩:২৫)
আগের আয়াতে ইহুদীদের কিছু বিকৃত চিন্তাভাবনার কথা উল্লেখ করার পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে ইহুদীরা যা ভাবছে তা সত্য নয়। আল্লাহর কাছে ইহুদী এবং অ-ইহুদীর মধ্যে কোন তফাৎ নেই। প্রত্যেকেই তার কাজ অনুযায়ী ফল পাবে। কোন বিশেষ ধর্মের অনুসারী হবার কারণে কেউ কোন বিশেষ সুবিধা পাবে এমনটি হবে না। আল্লাহর আইন সম্পূর্ণ ন্যায়ভিত্তিক। শাস্তি ও পুরস্কার দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহ বিন্দুমাত্র অবিচার করবেন না।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো,মানুষ তার বিশ্বাস ও কাজ অনুযায়ী পুরস্কার ও শাস্তি পাবে। কোন বিশেষ জাতি,বর্ণ ও ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে কেউ কোন অগ্রাধিকার পাবে না।
এরপর ২৬ ও ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَنْ تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَنْ تَشَاءُ بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (২৬) تُولِجُ اللَّيْلَ فِي النَّهَارِ وَتُولِجُ النَّهَارَ فِي اللَّيْلِ وَتُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَتُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَتَرْزُقُ مَنْ تَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ ((২৭
"বলুন,হে আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানিত কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল।" (৩:২৬)
"তুমি রাতকে দিনে এবং দিনকে রাতে পরিবর্তন কর আর তুমিই মৃত হতে জীবন্তের আবির্ভাব ঘটাও। তুমি যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবনোপকরণ দান কর।" (৩:২৭)
এই আয়াতে ইসলামের নবী ও মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে: প্রকৃত ক্ষমতা,শক্তি ও সম্মান আল্লাহরই হাতে। তাই তো দেখা যায় আল্লাহ কোন রকম রক্তপাত ছাড়াই মক্কার মুশরিকদের ওপর মুসলমানদের বিজয়ী করেছেন। ইরান ও রোমান সাম্রাজ্যের মানুষকেও আল্লাহই তোমাদের ধর্মের প্রতি আগ্রহী করেছেন এবং ইসলাম সারা বিশ্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে। এই আয়াত সম্পর্কে ইতিহাসে এসেছে আহজাবের যুদ্ধে মদীনা থেকে দূরে পরিখা খননের সময় হঠাৎ রাসুলের গাঁইতি একটি বড় পাথরের ওপর পড়ে যায় এবং এতে বিদ্যুৎ চমকে উঠে। হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেন,আমি এই বিদ্যুৎ চমকের মধ্যে কাফেরদের ওপর এবং মাদায়েন ও রোমের প্রাসাদের ওপর ইসলামের বিজয়ের ঔজ্জল্য দেখতে পাচ্ছি। মুসলমানরা এই সুসংবাদ শুনে তাকবীর ধ্বনি দিয়ে উঠলো। কিন্তু মোনাফিকরা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে বলল :
"তোমাদের কি অবাস্তব অলীক স্বপ্ন। শত্রুদের ভয়ে এখন পরিখা খনন করছ,অথচ তোমরা ইরান ও রোম সাম্রাজ্য দখলের স্বপ্ন দেখছ? আর এ সময়ই ঐ আয়াত নাজেল হয়। এ আয়াতে আল্লাহ মহানবীর উদ্দেশ্যে বলেন : এই সংকীর্নমনা লোকদের বলুন,বিশ্বজগতের মালিক ও প্রতিপালক হলেন আল্লাহ। তিনি শুধু আকাশ ও জমীন সৃষ্টিই করেননি,এর মধ্যে অবস্থিত সব কিছুর সুশৃঙ্খল ঘূর্ণন তথা নিজ অক্ষপথে ঘূর্ণনের ফলে রাত ও দিনের আবর্তন এসবই আল্লাহর হাতে। জীবন ও মৃত্যু,খাদ্য ও জীবিকা এবং সমস্ত প্রাণ তাঁরই হাতে। আল্লাহ যদি মুসলমানদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতা ও বিজয় দান করেন,তাহলে অমুসলমানরা কেন আশ্চর্য হবে? এবং সম্মান ও ক্ষমতা অর্জনের জন্য কেন তারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে যাবে? আল্লাহ আরো বলেছেন,মুসলমানদের মত তোমরাও যদি রাষ্ট্র ও ক্ষমতা চাও,তাহলে ধর্মের ছায়াতলে থেকে তা অনুসন্ধান কর এবং ইসলাম ধর্মের তথা আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্মের বিধান অনুযায়ী সমস্ত কাজ কর। আর এমনটি করলে আল্লাহ তোমাদেরকেও সম্মান ও ক্ষমতা দিবেন এবং কোন অত্যাচারীই তোমাদের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। বর্তমানে পৃথিবীর ওপর কুফুরী শক্তির আধিপত্য ও মুসলমানদের দুর্বল অবস্থার কারণ হলো -
প্রথমত : মুসলমানরা যখন অনৈক্য ও দলাদলিতে লিপ্ত থাকে,তখনই অত্যাচারীরা তাদের ওপর বিজয়ী হয় এবং মুসলমানদের মর্যাদা বিলুপ্ত হয়।
দ্বিতীয়ত :জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ক্ষেত্রে কাফেররাও যদি সচেষ্ট হয় এবং তারা যদি শৃঙ্খলাবদ্ধ থেকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে,তবে আল্লাহর নিয়ম অনুযায়ী তারাও রাষ্ট্র-ক্ষমতা ও সম্মানের অধিকারী হবে। এরই আলোকে বলা যায় আল্লাহ কাউকে বিনা কারণে সম্মানিত ও অপদস্থ করেন না। সম্মান ও দুর্গতির জন্য মানুষের তৎপরতাই দায়ী। আমরা নিজেরাই আমাদের কাজের মাধ্যমে নিজেদের ও সমাজের ভাগ্য নির্ধারণ করি।