সূরা আলে ইমরান;আয়াত ১০৫-১০৯
সূরা আলে ইমরানের ১০৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-
وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ (১০৫)
"হে মুসলমানরা! তোমরা তাদের মত হয়ো না,যারা তাদের কাছে স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি করেছে, তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।" (৩:১০৫)
আল্লাহর ধর্মের অনুসারীদের জন্য একটা বড় বিপদ হলো অনৈক্য ও দলাদলির বিপদ। ভাষাগত ও জাতিগত পার্থক্য, কিংবা কোন পুরনো দ্বন্দ্ব বা শাসন বিষয়ক সমস্যা নিয়ে এইসব অনৈক্য ও দলাদলি শুরু হয়। এর আগে আমরা আলোচনা করেছিলাম, আল্লাহ মুমিনদেরকে ঐক্যবদ্ধ ও পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে বলেছেন এবং মুমিনদেরকে একে অপরের ভাই বলে উল্লেখ করেছেন। তাই আল্লাহর ধর্মের অনুসারীরা তথা মুমিন মুসলমানরা বিশ্বের যে কোন প্রান্তেই থাকুক না কেন তাদের মধ্যে এক ধরনের আন্তরিক বন্ধন সৃষ্টি হয়। কোন ভৌগোলিক সীমারেখা বা জাতিয়তার দেয়াল তাদের এই আত্মিক বন্ধনের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে না। এমনকি সময় বা যুগের ব্যবধানও অতীতের একত্ববাদীদেরকে ভবিষ্যতের একত্ববাদী থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। এজন্যেই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ১৪০০ বছর আগে বলেছেন, 'যারা আগামীতে আসবেন তারা আমার ভাই। তাঁরা আমাকে দেখেননি, কিন্তু আমার ওপর ঈমান এনেছে। তাঁরাই আমার প্রকৃত ভাই।' সত্যিই, এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস সবচেয়ে দৃঢ় ও স্থায়ী ঐক্যের মাধ্যম। এই বিশ্বাস অতীতের একত্ববাদী ও বর্তমান যুগের একত্ববাদী এবং বিশেষ করে মুসলমানদের মধ্যে সহমর্মিতার মাধ্যম। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দুনিয়ার স্বার্থ বা রাজনৈতিক প্রলোভনের কারণে মুমিনদের মধ্যেও কোন কোন সময় প্রচণ্ড যুদ্ধ ও সংঘর্ষ হয়েছে। এমনকি ধর্মের শত্রুদের বিরুদ্ধেও বিশ্বাসীদেরকে এত ভয়াবহ যুদ্ধে জড়াতে হয়নি। এ আয়াতে মুমিনদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলা হচ্ছে, আত্মকলহ ও দ্বন্দ্বের পরিণামে ইহকাল ও পরকালে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : অজ্ঞতাই অধিকাংশ মতবিরোধের কারণ। অবশ্য অনেকে সত্যকে জানা সত্ত্বেও নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্য সত্যের বিরোধিতা করে এবং মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয়ত : পূর্ববর্তীদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। যেসব জাতি মতভেদ ও দলাদলিতে লিপ্ত হয়েছিল তারা কি সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছিল? নাকি পারস্পরিক ঐক্য ও সহমর্মিতার অধিকারী জাতিগুলোই সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছিল?
সূরা আলে ইমরানের ১০৬ ও ১০৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে
-
يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ فَأَمَّا الَّذِينَ اسْوَدَّتْ وُجُوهُهُمْ أَكَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ (১০৬) وَأَمَّا الَّذِينَ ابْيَضَّتْ وُجُوهُهُمْ فَفِي رَحْمَةِ اللَّهِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ (১০৭)
"কিয়ামতের দিন কারো কারো মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হবে,কারো কারো মুখ কালো বর্ণের হবে। যাদের মুখ কালো বর্ণের হবে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে ঈমানদার হবার পর কেন তোমরা কাফের হয়েছিলে? অতএব অবিশ্বাসের কারণে তোমরা শাস্তি আস্বাদ কর।" (৩:১০৬)
"কিন্তু যাদের মুখ উজ্জল হবে, তারা আল্লাহর করুণা লাভ করবে এবং তারা সেখানে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে।" (৩:১০৭)
পৃথিবীতে আমাদের ভালো ও মন্দ যে কোন কাজের গভীর ও অগভীর দু'টি দিক রয়েছে। বাহ্যিক বা অগভীর দিক হলো,যা আমরা দেখছি ও শুনছি। আর অন্তর্নিহিত বা গভীর দিক হলো,যা আমাদের আত্মা এবং মন মানসিকতায় প্রভাব ফেলে। ইহকাল হলো প্রকাশের জগত,অন্যদিকে পুনরুত্থান বা পরকাল হলো, অন্তর্নিহিত জগত। কারণ, বাহ্যিক কাজগুলো ইহকালে তথা পৃথিবীতে দেখা যায়। আর এসব কাজের অন্তর্নিহিত দিক পরকালে স্পষ্ট হবে। তাই পরকালে মানুষের কাজ অনুযায়ী তাদের চরিত্রের গোপন দিক ও আসল চেহারা ফুটে উঠবে। এই আয়াতে কিয়ামতের দিন মানুষের চেহারা উজ্জল ও অন্ধকার হবার কথা বলা হয়েছে যা মানুষের অন্তর্নিহিত চরিত্র প্রকাশ করবে। দুনিয়াতে অবিশ্বাস ও সত্য গোপনের জন্য পরকালে মানুষের চেহারা ও চরিত্র থেকে ঈমানের নূর দূর হবে এবং চরিত্রের গোপন নোংরা দিকগুলো স্পষ্ট হবে। নিঃসন্দেহে অন্যদের সামনে কালো চেহারা ফুটে ওঠা এবং নোংরা চরিত্র স্পষ্ট হওয়ার চেয়ে কঠিন শাস্তি আর কিছুই হতে পারে না। অন্যদিকে কিয়ামতের দিন মুমিনদের উজ্জ্বল চেহারা প্রকাশের মাধ্যমে তাদের সুন্দর ও পবিত্র চরিত্র ফুটিয়ে তোলা হবে এবং আল্লাহর অসীম রহমত পেয়ে তারা ধন্য হবে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত: যদি আমরা ইহকালে সত্যপন্থী ও মজলুম চেহারার মাধ্যমে অন্যদের বিশ্বাসভাজন হতে পারি তাহলে কেয়ামতের দিনও আমাদের চেহারা হবে নূরানী।
দ্বিতীয়ত : বর্তমানে ঈমানদার হবার কারণে আমরা যেন অহংকারী হয়ে না পড়ি। কারণ মুমিনরাও যে কোন মুহূর্তে কুফুরির বিপদে আক্রান্ত হতে পারে।
সূরা আলে ইমরানের ১০৮ ও ১০৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন-
تِلْكَ آَيَاتُ اللَّهِ نَتْلُوهَا عَلَيْكَ بِالْحَقِّ وَمَا اللَّهُ يُرِيدُ ظُلْمًا لِلْعَالَمِينَ (১০৮) وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَإِلَى اللَّهِ تُرْجَعُ الْأُمُورُ (১০৯)
"এগুলো আল্লাহর নিদর্শন,যা আমি তোমার কাছে সত্যতা সহকারে বর্ণনা করছি। আল্লাহ বিশ্ব জগতের কারো ওপর জুলুম করতে চান না।" (৩:১০৮)
"আর আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর এবং আল্লাহর কাছেই সব কিছু ফিরে যাবে।" (৩:১০৯)
এই দুই আয়াতে রাসুলে খোদা ও মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য করে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতির কথা বলা হয়েছে। আর তা হলো ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে আল্লাহ পাক মানুষের উপর সাধ্যাতীত কোন বিধান চাপিয়ে দেন না কিংবা পুরস্কার ও শাস্তির ক্ষেত্রে কোন জুলুম করেন না। কেয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে একদল থাকবে হাসি খুশি ও উৎফুল্ল। আর অন্য একদলকে দেখা যাবে খুবই বিষন্ন চেহারায়। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে, আল্লাহ এ রকম চেয়েছিলেন কিংবা বাধ্যবাধকতার চাপে এমনটি হয়েছে। বরং সবই হচ্ছে পৃথিবীতে মানুষের কৃতকর্মের ফসল। পরকালে কেউ যদি দোযখে যায় তার অর্থ এটা নয় যে, আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন। বরং মানুষ নিজেরাই তাদের খারাপ কাজের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় দোজখের আগুন তৈরি করে। মূলত: অন্যের প্রতি জুলুম বা অন্যায়ের কারণ হচ্ছে অজ্ঞতা,অক্ষমতা,প্রয়োজন, কিংবা শক্তিপ্রদর্শন বা প্রতিশোধ স্পৃহা। কিন্তু যে আল্লাহপাক সমস্ত বিশ্ব জাহানের মালিক এবং সব প্রয়োজন ও ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে। তাঁর কী প্রয়োজন অন্যের ওপর জুলুম করার বা প্রতিশোধ নেয়ার কিংবা শক্তি দেখানোর? তিনি নিজেই যেখানে আমাদেরকে জুলুম অত্যাচার থেকে বিরত থাকতে বলেন,তিনি কীভাবে তার বান্দাদের প্রতি জুলুম করবেন? আল্লাহপাক নিজেই যেখানে দয়া ও রহমতের উৎস,তিনি কীভাবে নিজ সৃষ্টির ওপর অত্যাচার করবেন ?
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : আমরা যে আল্লাহয় বিশ্বাসী,তিনি তার সৃষ্টি,নিয়ম-কানুন নির্ধারণ, শাস্তি ও পুরস্কারের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারক।
দ্বিতীয়ত : সৃষ্টির সূচনা যেমন আল্লাহর কাছ থেকে তেমনি সৃষ্টির পরিসমাপ্তিও আল্লাহর হাতে। সৃষ্টি জগতের কোন অস্তিত্ব তার বাইরে নয়। জগতের কোন কিছুই নিঃশেষ হয় না বরং আল্লাহর শক্তির মধ্যে সব সময় বিরাজমান।