সূরা আলে ইমরান;(১৯তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আলে ইমরান;(১৯তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 3:25:36 20-8-1403

সূরা আলে ইমরান;আয়াত ১০০-১০৪

সূরা আলে ইমরানের ১০০ ও ১০১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহপাক বলেছেন-


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنْ تُطِيعُوا فَرِيقًا مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ يَرُدُّوكُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ كَافِرِينَ ( (১০০وَكَيْفَ تَكْفُرُونَ وَأَنْتُمْ تُتْلَى عَلَيْكُمْ آَيَاتُ اللَّهِ وَفِيكُمْ رَسُولُهُ وَمَنْ يَعْتَصِمْ بِاللَّهِ فَقَدْ هُدِيَ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ (১০১)



"হে বিশ্বাসীগণ! যাদের গ্রন্থ দেয়া হয়েছে,তুমি যদি তাদের কোন এক দলের অনুসরণ কর,তবে তারা তোমাদেরকে ঈমান আনার পর আবার অবিশ্বাসী করে ফেলবে।" (৩:১০২)
"আল্লাহর নিদর্শনাবলী বা আয়াত তোমাদের কাছে পড়ে শোনানোর পরও এবং তোমাদের মধ্যে রাসূল থাকা সত্ত্বেও কীভাবে তোমরা অবিশ্বাস করতে পার? যারা আল্লাহর পথ অবলম্বন করবে,তারাই সরল পথে পরিচালিত হবে।" (৩:১০১)

মহানবী (সা.) মদীনায় আসার পর তাঁর নেতৃত্বে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর ফলে এই শহরের বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ফিরে আসে। মদীনায় ‘আওস'ও ‘খাজরাজ'নামের দুই গোত্রের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকলেও মহানবীর নেতৃত্বের ছায়াতলে তাদের মধ্যে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কোন কোন ইহুদী নেতা মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যকে নিজেদের জন্য বিপজ্জনক মনে করে মুসলিম ঐক্যে ভাঙ্গন সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চালাতে থাকে। তারা ঐ দুই গোত্রের কোন একজন মুসলমানকে পূর্ব শত্রুতা ও বিভিন্ন যুদ্ধের স্মৃতি প্রচারের দায়িত্ব দেয়। যাতে গোত্র প্রধানরা পুনরায় উত্তেজিত হন। ইহুদীদের এ ষড়যন্ত্রের ফলে আওস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে পুনরায় যুদ্ধ লেগে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় এবং এ অবস্থায় কোরআনের আয়াত নাজেল হয়। এই আয়াতে শত্রুদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে মুসলমানদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হচ্ছে,শত্রুরা মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভক্তির ষড়যন্ত্র করছে এবং তারা এজন্যে খোদায়ী পথ-নির্দেশনা থেকে মুসলমানদেরকে দূরে সরিয়ে নিতে চায়। কারণ,নবী ও আল্লাহর কিতাবের অস্তিত্ব হলো ঐক্যের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম এবং রাসূলের নির্দেশ মেনে চলাই হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশিত সরল সঠিক পথ। তাই মুসলমানদেরকে সবসময়ই ঐক্যের এই রজ্জু আঁকড়ে ধরতে হবে। শত্রুরা ঈমানদারদের মধ্যে কোন্দল ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টির জন্য বন্ধু সেজে উপদেশ এবং উসকানি দিলেও তাতে প্রভাবিত হওয়া যাবে না।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রথমত : শত্রুরা চায় মানুষ যেন আল্লাহর নবী ও তার কিতাবের অনুসরণ না করে। তাই এমন কিছু করা উচিত নয়,যাতে শত্রুদের এই ইচ্ছে পূরণ হয়।
দ্বিতীয়ত : বর্তমানে আমরা ঈমানদার বা বিশ্বাসী এরকম অহংকার যেন আমাদের পেয়ে না বসে।কারণ,অনেক মুমিন বা বিশ্বাসী ঈমানের ওপর অটল থাকতে পারেন নি।
তৃতীয়ত : বিভ্রান্তি থেকে রক্ষার জন্য শুধু আল্লাহর কিতাব ও আল্লাহর আইনই যথেষ্ট নয়। খোদায়ী পথ প্রদর্শক ও তার অনুসরণও জরুরী।
চতুর্থত : সরল সঠিক পথে চেষ্টা চালানো হলে সে চেষ্টা সফল হয়। ভুল পথে বা পদ্ধতিতে যত চেষ্টাই করা হোক না কেন ঐসব চেষ্টা সফল হয় না।

সূরা আলে ইমরানের ১০২ ও ১০৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ (১০২) وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آَيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ (১০৩)

"হে বিশ্বাসীগণ তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর এবং তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করোনা।" (৩:১০২)
"তোমরা সবাই আল্লাহর রশ্মিকে দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়োনা। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে দয়ার সঞ্চার করেন,ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তে ছিলে,আল্লাহই তোমাদেরকে সেখান থেকে উদ্ধার করেছেন। এভাবে আল্লাহ তোমাদের কাছে নিজের নিদর্শন তুলে ধরেন,যেন তোমরা সুপথ পাও।" (৩:১০৩)

নবীদের শিক্ষালয়ে মুমিনরা হলেন ছাত্র। এখানে উন্নতির জন্য পর্যায়ক্রমে উচ্চ পর্যায়ের ক্লাস রয়েছে। আর ক্রমে উপরের পর্যায়ে পৌঁছানোই মুমিনদের বৈশিষ্ট্য। জ্ঞান মানুষের জন্য আল্লাহর অন্যতম অনুগ্রহ এবং এটা এমন এক নেয়ামত যে,মহানবী(সা.) নিজেও তাঁর জ্ঞান বৃদ্ধির জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন। মহানবী (সা.) বলতেন ‘রাব্বি জিদনি ইলমা'। অনুরূপভাবে খোদাভীতি এবং ঈমানেরও বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। আল্লাহ সূরা আলে ইমরানের ১০২ নম্বর আয়াতে ঈমানের উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছার জন্য মুসলমানদের প্রতি পরামর্শ দিয়ে বলছেন তোমরা আল্লাহকে ততটা ভয় কর যতটা ভয় তাঁকে করা উচিত। উঁচু পযার্য়ের খোদাভীতি তোমাদেরকে যেমন খারাপ কাজ থেকে রক্ষা করবে,তেমনি তা সৎকাজ করতেও উৎসাহ যোগাবে। সূরা আলে ইমরানের ১০৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তার ধর্মের আওতায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলছেন ভেবে দেখো বা এটা ভুলে যেওনা যে,ঈমান আনার আগে তোমাদের মধ্যে কত দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ হয়েছে। তোমরা ধ্বংসের অতল গহ্বরের মুখোমুখী হয়েছিলে। যে কোন সময় অপবিত্রতার চোরাবালিতে তোমাদের পতন ঘটতে পারতো। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের অন্তরে দয়া সঞ্চার করে এমন পরিবর্তন আনলেন যে,তোমরা পরস্পরের ভাই হয়ে গেলে। আর এজন্যেও আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা তোমাদের কর্তব্য।

এ দুই আয়াত থেকে আমরা যা শিখতে পারি তা হলোঃ
প্রথমত : মানুষ কিভাবে মারা যাবে,তা নির্ভর করে তার বর্তমান জীবন যাপন পদ্ধতির ওপর। একমাত্র খোদাভীতি ও পবিত্র থাকার মাধ্যমেই মানুষ ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে এবং সুখময় পরিণতির অধিকারী হতে পারে।
দ্বিতীয়ত : সমাজের ঐক্য জাতি,ভাষা ও বর্ণের ওপর নির্ভর করে টিকে থাকতে পারে না। একমাত্র আল্লাহর ধর্মের ছায়াতলেই প্রকৃত ও স্থায়ী ঐক্য গড়ে ওঠে।
তৃতীয়ত : রাজনৈতিক,সামরিক কিংবা আন্তর্জাতিক চুক্তির আওতায় যেসব ঐক্য হয় তা বেশী দিন স্থায়ী হয় না। স্থায়ী ও প্রকৃত ঐক্য গড়ে ওঠে মানুষের অন্তরের ঘনিষ্ঠতা ও ভালবাসার মাধ্যমে। আর এই ভালবাসার চাবিকাঠি থাকে আল্লাহর হাতে।
চতুর্থত : আল্লাহর দান ও নেয়ামতের স্মরণ মানুষকে খোদা-প্রেমিক করে এবং এর ফলে মানুষ আল্লাহর দেওয়া বিধান মেনে চলে। কিন্তু মানুষ যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও নেয়ামতের কথা ভুলে যায়,তাহলে আল্লাহও তাদেরকে তাঁর নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করেন।

সূরা আলে ইমরানের ১০৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (১০৪)


"মুসলমানদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত,যারা মানুষকে সৎ কাজের আহ্বান জানাবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে। এরাই হলো সফলকাম।" (৩:১০৪)

মানুষের জীবন সমাজবদ্ধ জীবন। সামাজিক জীবনে কোন আচার আচরণ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অন্যদের ওপরও প্রভাব ফেলে। এদিক থেকে মানব সমাজ যেন একটি বড় জাহাজের মত। কোন অসচেতন বা হিংসুক ব্যক্তি এই জাহাজ ফুটো করে সবার মৃত্যু ঘটাতে পারে। তাই এ জাহাজের যাতে কোন ক্ষতি না হয়,সেজন্য সমাজের প্রত্যেক সদস্যেরই দায়িত্ব রয়েছে। আর বিবেকের এই নির্দেশই ইসলাম ধর্মে প্রতিফলিত হয়েছে। যেখানে সৎ ও ভালো কাজের চর্চা নেই,সেখানে সৎ কাজের দিকে আহ্বান জানানো প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব। আর যেখানে অন্যায় বা অসৎ কাজ হচ্ছে সেখানে বাধা দেয়া বা নিষেধ করাও প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। তাই প্রত্যেক মুসলমানকে তার সাধ্য অনুযায়ী এ দু'টি দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন সামগ্রিকভাবে এই গণ-দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও অবশ্যই সুশৃঙ্খল ও সংঘবদ্ধ কোন একটি দল থাকা দরকার যারা শক্তি দিয়ে দৃঢ়তার সাথে সমাজে সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজের প্রতিরোধ করবে। কোন অসচেতন গাড়ী চালক একমুখী সড়কে ‘রং সাইডে'বা ভুল দিকে গাড়ী চালালে লাল বাতি জ্বালিয়ে বা বাঁশী বাজিয়ে তাকে সাবধান করা হয় এবং অন্যদিকে পুলিশ তার গাড়ী থামিয়ে তাকে জরিমানা করে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো,সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ সম্পর্কিত আয়াত এমন দুই আয়াতের মাঝখানে স্থান পেয়েছে যাতে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। এর রহস্য হলো,সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ যেন সমাজে বিভক্তি ও অনৈক্য ডেকে না আনে। কারণ,সমাজ বিভক্ত থাকলে এ ধরনের মহতী আহ্বান খুব একটা কার্যকরী হবে না।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত: সমাজের এমন কিছু গ্রুপ থাকা দরকার যারা সমাজের কোথাও খারাপ কাজ হচ্ছে কিনা তা লক্ষ্য রাখবে এবং তাতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করবে।
দ্বিতীয়ত: সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আন্তরিকতার ওপর কল্যাণ ও সৌভাগ্য নির্ভরশীল। সমাজ থেকে দূরে থাকলে বা সমাজকে এড়িয়ে চললে কিংবা সমাজের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে চুপচাপ ঘরের এক কোণে বসে থাকলে কল্যাণ ও সৌভাগ্য অর্জিত হবে না।
তৃতীয়ত : মুমিন বা প্রকৃত বিশ্বাসীকে শুধু নিজের মুক্তির কথা চিন্তা করলেই হবেনা,সমাজের অন্যান্য সদস্যদের মুক্তি ও তাদের উন্নতির জন্যেও চেষ্টা করতে হবে।
চতুর্থত : সৎ কাজের আদেশকে মন্দের প্রতিরোধের চেয়ে বেশী প্রাধান্য দেয়া উচিত। সৎ কাজের প্রচলন ঘটাতে পারলে অন্যায় বা মন্দ কাজের পরিবেশও সংকুচিত হয়ে পড়বে।